সন্তান-সন্তুতিকে নৈতিক শিক্ষাদান? ইসলাম কী বলে চরিত্র গঠনের বিষয়ে?

প্রতিদিনের ইসলামী পোস্ট - Get Study Online

দরসে হাদিসঃ সন্তান-সন্তুতিকে নৈতিক শিক্ষাদান

আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ কোথায় যাচ্ছে? ইসলাম কী বলে চরিত্র গঠনের বিষয়ে?

সন্তান আল্লাহর দেওয়া এক মহান নিয়ামত। এই নিয়ামতকে সঠিক পথে পরিচালনা করা যেমন পিতা-মাতার দায়িত্ব, তেমনি তা একটি ইবাদতের সমতুল্য। বর্তমান যুগে সন্তানদের মাঝে আদর্শ, নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। কারণ শিশুকালেই তাদের অন্তরে যে শিক্ষা রোপণ করা হয়, সেটিই তাদের পরবর্তী জীবনের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।

সন্তান-সন্তুতিকে নৈতিক শিক্ষাদান? ইসলাম কী বলে চরিত্র গঠনের বিষয়ে?

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সন্তানদের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন—নবীপ্রেম, আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা, এবং কুরআন তিলাওয়াত। এই তিনটি গুণ একজন শিশুকে একজন আদর্শ মুসলমান হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করে।

এই ব্লগ পোস্টে আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীসের আলোকে জানব কীভাবে সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা দেওয়া যায়, কেন নবীপ্রেম ও আহলে বাইতের ভালোবাসা জরুরি, এবং কীভাবে কুরআনের আলোয় তাদের জীবন গড়ে তোলা সম্ভব।

★ দরসে হাদিসঃ সন্তান-সন্তুতিকে নৈতিক শিক্ষাদান | ইসলামিক আদর্শে সন্তানের চরিত্র গঠন
📖 হাদিস শরীফ:
عَنْ عَلىَّ رَضى الله عنه ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قالَ:
ادّبوا اولادكم على ثلاث خصالٍ حُبّ نبيكم وحب الى بيته وتلاوة القران فان حملة القران فى ظل عرش الله يوم لاظِلَّ اِلا ظلّه مع اصفيابه
[رواه الطبرانى]

🔸 অনুবাদ:
হযরত আলী (রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেছেন:
“তোমাদের সন্তানদের তিনটি বিষয় শিক্ষা দাও—তোমাদের নবীর প্রতি ভালোবাসা, তাঁর পরিবার ও বংশধরদের প্রতি ভালোবাসা এবং কুরআন তিলাওয়াত। কেননা কুরআনের জ্ঞানধারীরা আল্লাহর আরশের ছায়ায় অবস্থান করবে যেদিন আর কোনো ছায়া থাকবে না, এবং তারা নবী ও ওলীগণের সাথে থাকবে।”
📚 তাবরানী শরীফ

✨ হাদিসের তাৎপর্য ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা
এই হাদিসে ইসলামি আদর্শে সন্তানের নৈতিক শিক্ষা ও চরিত্র গঠনের এক চমৎকার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। সন্তান-সন্তুতি আল্লাহর এক অমূল্য নেয়ামত। তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারলে, তারা ভবিষ্যতে পিতা-মাতার গর্ব ও উজ্জ্বল পরিচয় হয়ে ওঠে।

অন্যদিকে যদি সন্তান নৈতিকতা ও আদর্শবর্জিত পরিবেশে গড়ে ওঠে, তা সমাজ ও জাতির জন্য অকল্যাণকর হয়ে উঠতে পারে।

১. সন্তানের অন্তরে নবীপ্রেম সৃষ্টি

🔹 কী শিক্ষা দেওয়া উচিত?

  • নবীজির (সা.) প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা সৃষ্টি করা।
  • তাঁর জীবনী, ত্যাগ ও কুরবানির গল্প শোনানো।
  • নিয়মিত দরূদ শরীফ পাঠে উৎসাহিত করা।

🔹 কীভাবে শুরু করবেন?

  • ঈদে মিলাদুন্নবী, জশনে জুলুসে অংশগ্রহণ।
  • সুন্নী আক্বিদাভিত্তিক মাহফিল ও আলোচনা সভায় নিয়ে যাওয়া।
  • অভিজ্ঞ আলেমদের কাছ থেকে কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী জ্ঞান গ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া।

২. সন্তানের অন্তরে আহলে বাইতের মহব্বত সৃষ্টি

🔹 আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা কেন জরুরি?

  • ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
  • নামাজের দরূদে তাঁদের প্রতি সালাম ফরজ।
  • তাঁদের ত্যাগ ও আদর্শ ইসলামের প্রচার ও প্রসারে অপরিসীম অবদান রেখেছে।

🔹 কীভাবে সন্তানের মনে এই মহব্বত গড়ে তুলবেন?

  • আহলে বাইতের জীবনচরিত ও ইতিহাস পড়ানো।
  • তাঁদের আদর্শ ও অবদান সম্পর্কে সচেতন করা।
  • পরিবারের আলোচনায় তাঁদের স্মরণ ও সম্মান করা।

কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা: ইসলামি জীবনের প্রথম ধাপ

📖 কুরআন তিলাওয়াত: শ্রেষ্ঠ ইবাদতের মাধ্যম
ইসলামে কুরআন তিলাওয়াত হলো সর্বোত্তম ইবাদত। আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে নাযিলকৃত এই মহাগ্রন্থ মানবজাতির নৈতিকতার মূল উৎস। এমনকি কেউ যদি অর্থ না বুঝেও কুরআন তিলাওয়াত করে, তবুও প্রতিটি অক্ষরের বিনিময়ে সে পায় দশটি নেকী।

আল কুরআন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান, যা আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে মানবতার জন্য পাঠানো হয়েছে। যে সকল মুসলিম কুরআনের উপর বিশ্বাস রাখেন, তাদের উচিত এই কিতাবকে হৃদয়ে ধারণ করা, তার অর্থ অনুধাবন করা, শিক্ষা গ্রহণ করা ও অন্যদের মাঝে প্রচার করা।

📚 হাদীসের আলোকে কুরআন শিক্ষা
রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
“তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই, যে কুরআন শিখে এবং অন্যকে শিখায়।” [সহীহ বুখারী]

📌 আল কুরআনের সত্যতা ও গুরুত্ব
কুরআন এমন এক মহাগ্রন্থ, যার সত্যতার ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। এতে বর্ণিত প্রতিটি শব্দ, বক্তব্য ও তথ্য শাশ্বত এবং নির্ভুল। দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে কেউ কুরআনের নির্ভুলতা চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি।

কুরআনে রয়েছে—মানুষের কল্যাণ ও অকল্যাণ, হালাল-হারামের পরিচয়, জান্নাত ও জাহান্নামের পথ, আল্লাহ্‌ ও রসূলের সন্তুষ্টি এবং অসন্তুষ্টির নির্দেশনা।

📉 আজকের সমাজ ও কুরআন বিমুখতা
দুঃখজনক হলেও সত্য, আজকের মুসলিম সমাজ কুরআনের শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বর্তমানের ছাত্র-যুব সমাজ কুরআনের আবেদন সম্পর্কে অজ্ঞ। অনেক পরিবারে সন্তানেরা কুরআন পড়তে জানে না। অনেকে পড়তে পারলেও এর অর্থ ও তাৎপর্য জানার আগ্রহ নেই।

🧒 সন্তানদের কুরআন শিক্ষায় উৎসাহিত করুন
মুসলিম পরিবারগুলোতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব থাকলেও কুরআনের প্রতি থাকে চরম উদাসীনতা। অথচ কুরআনই মানবতার শ্রেষ্ঠ শিক্ষাগ্রন্থ।

আপনার সন্তানকে কুরআন পড়তে, বুঝতে এবং জীবনে বাস্তবায়ন করতে উদ্বুদ্ধ করুন। পরিবারের প্রতিটি সদস্য ও সহকর্মীদের মাঝে কুরআনের শিক্ষা ছড়িয়ে দিন।

🌟 কুরআনের সাথে জীবনের সম্পর্ক গড়ে তুলুন

  • কুরআনের সাথে বন্ধন গড়ুন
  • নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করুন
  • কুরআনের অর্থ অনুধাবনের চেষ্টা করুন
  • কুরআনের আদর্শে সন্তানকে গড়ে তুলুন
  • কুরআনের ব্যাখ্যা ও নির্ভরযোগ্য তাফসীর অধ্যয়ন করুন
  • বিশেষ করে “আ’লা হযরত অনূদিত কানযুল ঈমান” এর বাংলা অনুবাদ সংগ্রহ করে তা নিয়মিত পড়া ও অন্যদের পড়তে উৎসাহিত করা উচিত। এটি ঈমান ও আক্বিদা সুরক্ষার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।

📖 সাহাবায়ে কেরাম ও আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অনুসরণ করুন
কুরআনের আলোকে নবীজির সাহাবা, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন, মুজতাহিদ ইমামগণ এবং আউলিয়ায়ে কেরামদের জীবনী অধ্যয়ন করুন। তাঁদের আদর্শ গ্রহণ করলে আপনি নিজেও হিদায়াতের পথে অগ্রসর হবেন, ইন শা আল্লাহ।

সন্তানদের ইবাদতে অভ্যস্ত করা: ইসলামী পরিবার গঠনের ভিত্তি
শিশুকাল থেকেই সন্তানদের অন্তরে নামাজের ভালোবাসা সৃষ্টি করা পিতা-মাতার দায়িত্ব। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

“তোমাদের সন্তানদের নামাযের নির্দেশ দাও যখন তারা সাত বছর বয়সে উপনীত হয় এবং দশ বছর হলে জোর দিয়ে তা আদায় করাও। তখন তাদের জন্য পৃথক বিছানার ব্যবস্থা করো।” [আবু দাউদ]

সন্তানদের মাঝে সমতা রক্ষা – ইসলামের মহান শিক্ষা

সন্তানদের প্রতি সমতা রাখা—এটি ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। ছেলে হোক বা মেয়ে, ইসলামের দৃষ্টিতে উভয়ের প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গি রাখা আবশ্যক।

✅ সন্তানদের মধ্যে সমতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ তা হলো:

  • ভরণ-পোষণ
  • খাদ্য ও চিকিৎসা
  • অন্ন ও বস্ত্র
  • আদর, ভালোবাসা এবং মায়া-মমতা

ইসলাম চায়, প্রতিটি সন্তান যেন তার ন্যায্য অধিকার পায় এবং কোনও ধরণের বৈষম্যের শিকার না হয়।

📖 হাদীসে নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন:

اعدلوا بين ابنائكم اعدلوا بين ابنائكم
অর্থ: তোমরা তোমাদের সন্তানদের মাঝে ন্যায়বিচার করো, ইনসাফ করো। (রেওয়ায়েত: ইমাম নাসাঈ)

🔹 এই হাদীস আমাদের স্পষ্টভাবে শিক্ষা দেয় যে, সন্তানদের মধ্যে ন্যায্যতা ও সমতা বজায় রাখা একটি অত্যাবশ্যক দায়িত্ব।

📌 পরিশেষে একটি দোআ:
আল্লাহ্‌ যেন আমাদের সন্তানদের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার তাওফিক দান করেন।
আমিন।

উপসংহার: পিতা-মাতা হল সন্তানের প্রথম শিক্ষাগুরু। তাদের দায়িত্ব হল সন্তানকে নবীপ্রেম ও কুরআন তিলাওয়াতের শিক্ষা দেওয়া এবং আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ করা। এর মাধ্যমেই সন্তানের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল ও আলোকিত হবে এবং সমাজ পাবে এক একজন নৈতিক ও চরিত্রবান মানুষ।

Related posts

Leave a Comment