হযরত আবু বকর রাঃ এর জীবনী রচনা পর্ব -০১
হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) জীবনী ও ঘটনা
ইসলামের প্রথম খলিফা ছিলেন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)। তিনি “আতীক” নামেও পরিচিত। হাদিসে এই নামের বিভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল আব্দুল্লাহ। পিতার নাম ছিল উসমান (অন্য নাম আবু কুহাফা) এবং মাতার নাম ছিল উম্মুল খায়র সালমা বিনতে সাখ্র। তাঁদের উভয়েই মক্কার কা’ব ইবন সা’দ ইবন তায়ম ইবন মুর্রা গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
প্রচলিত মতে, আবু বকর (রাঃ) ছিলেন হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর চেয়ে তিন বছরের ছোট। তিনি মক্কার একজন ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন এবং নবী করিম (সঃ)-এর অন্যতম প্রাচীন সমর্থক। অনেকের মতে, তিনি পুরুষদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী।
আরো পড়ুন : প্রতিদিনের ইসলামিক গল্প – অকালের ফল
আবু বকর (রাঃ)-এর অন্যতম বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল নবী (সঃ)-এর প্রতি তাঁর অটল বিশ্বাস। হযরত (সঃ)-এর মিরাজের ঘটনা শুনে যখন অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল, তখনও তিনি অবিচল ছিলেন। এই দৃঢ় বিশ্বাসের কারণে তিনি “আস-সিদ্দীক” উপাধি লাভ করেন।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত নম্র প্রকৃতির। কুরআন তিলাওয়াত করতে গিয়ে তাঁর চোখ থেকে অশ্রু ঝরত। তাঁর কন্যা আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, হিজরতের সময় নবী করিম (সঃ)-এর সঙ্গে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে তিনি আনন্দে কেঁদে ফেলেন।
হযরত আবু বকর রাঃ এর আত্মত্যাগ এবং ইসলামের প্রতি অবদান
হযরত আবু বকর (রাঃ) বহু ক্রীতদাসকে মুক্ত করে এবং বিভিন্ন সেবামূলক কাজের মাধ্যমে ইসলামের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন। ইসলামের জন্য তিনি তাঁর সম্পদের সিংহভাগ ব্যয় করেছেন। মদিনায় হিজরতকালে তাঁর ৪০ হাজার দিরহাম সম্পদের মধ্যে মাত্র ৫ হাজার দিরহাম সঙ্গে নিতে পেরেছিলেন।
মক্কায় কুরাইশদের পক্ষ থেকে যখন নবী করিম (সঃ)-এর ওপর কঠোর অত্যাচার শুরু হয়, তখন আবু বকর (রাঃ) দৃঢ়ভাবে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। নবী করিম (সঃ)-এর মদিনায় হিজরতের সময়ও তিনি তাঁর একান্ত সঙ্গী ছিলেন।
আবু বকর (রাঃ)-এর পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য মদিনায় হিজরত করেন। তবে তাঁর ছেলে আব্দুর রহমান বদর যুদ্ধে কাফেরদের পক্ষে লড়াই করেছিলেন। পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মদিনায় হিজরত করেন।
আরো পড়ুন : প্রতিদিনের ইসলামিক গল্প – অকালের ফল
খিলাফতের সময়কার অবদান – হযরত আবু বকর রাঃ এর জীবনী রচনা
নবী করিম (সঃ)-এর ইন্তেকালের পর মুসলিম উম্মাহ যখন বিচলিত ছিল, তখন হযরত উমর (রাঃ)-এর প্রস্তাবে আবু বকর (রাঃ) প্রথম খলিফা নির্বাচিত হন। তিনি নবী করিম (সঃ)-এর আদর্শ অনুসরণ করে মুসলিম সমাজকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে সক্ষম হন।
তাঁর শাসনামলে মুরতাদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সেনাপতি খালিদ ইবনুল ওয়ালিদসহ অন্যান্য সেনাদের সফল নেতৃত্বে আরব ভূমি শান্তি ফিরে পায়।
আবু বকর (রাঃ) ছিলেন অত্যন্ত সরল ও বিনয়ী। তিনি কখনও বিলাসবহুল জীবনযাপন করেননি। তাঁর চেহারা, পোশাক এবং বক্তৃতার মাধ্যমে তাঁর ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা প্রতিফলিত হতো। তিনি ছিলেন ইসলামের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের জন্য নিবেদিত ছিলেন।
হযরত মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর শিক্ষার বিশুদ্ধ নৈতিক উপদেশগুলো তার মনে গভীর অনুভূতি সৃষ্টি করত। অনেক দাস কিনে তিনি তাদের মুক্তি দিতেন এবং এ ধরনের আরও কাজের মাধ্যমে তা প্রমাণ করতেন। ইসলামের জন্য কোনো আত্মত্যাগই তার কাছে বড় মনে হতো না। এর ফলশ্রুতিতে, তার ৪০ হাজার দিরহাম মূল্যের সম্পত্তি থেকে মাত্র ৫ হাজার দিরহাম সঙ্গে নিয়ে মদিনায় যেতে সক্ষম হন। কঠিন বিপদের মধ্যেও তিনি বিশ্বস্ততার সঙ্গে তার বন্ধু ও শিক্ষকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন।
সবচেয়ে সংকটময় সময়ে যে অল্প সংখ্যক লোক আবিসিনিয়ায় হিজরত করেনি, তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। যখন বানু হাশিমকে মক্কা সমাজ থেকে বহিষ্কার করা হয়, তখন একবার তিনি কিছুটা বিচলিত হয়েছিলেন এবং মক্কা ত্যাগ করেছিলেন। তবে এক প্রভাবশালী মক্কাবাসীর আশ্রয়ে শীঘ্রই ফিরে আসেন। সেই রক্ষক তাকে একসময় একা ছেড়ে দিলেও তিনি মক্কায় অবস্থান করতেন। তার জীবনের সবচেয়ে গৌরবের দিন আসে যখন হযরত মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মদিনায় হিজরত করার সময় তাকে সঙ্গী হিসেবে মনোনীত করেন।
আল্লাহ্ তাআলা কুরআনে তাকে “দুই জনের মধ্যে দ্বিতীয়” (সুরা ৯ঃ আয়াত ৪০) বলে অভিহিত করে তার আত্মত্যাগের জন্য পুরস্কৃত করেছেন। তার পরিবার থেকে সবাই মদিনায় হিজরত করেন, শুধু তার ছেলে আব্দুর রহমান ছাড়া। আব্দুর রহমান কাফির থাকা অবস্থায় বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অংশ নেন। পরবর্তীতে তিনিও ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মদিনায় হিজরত করেন। মদিনায় এসে আবু বাকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সুনুহ শহরতলীতে একটি সাধারণ গৃহস্থালীর ব্যবস্থা করেন।
হিজরতের পূর্বে ৬২০ খ্রিস্টাব্দে হযরত মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার কন্যা আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)-কে বিয়ে করেছিলেন। এই বিয়ের মাধ্যমে তাদের বন্ধন আরও দৃঢ় হয়। আবু বাকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) প্রায়ই হযরত মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সঙ্গে থাকতেন এবং তার সব অভিযানে অংশ নিতেন। তবে তাকে সামরিক অভিযানের পরিচালকের দায়িত্ব খুব কম দেওয়া হতো।
তাবুক অভিযানে তার ওপর পতাকা বহনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। নবম হিজরিতে (৬৩১ খ্রিস্টাব্দে) হযরত মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে হজ পরিচালনার জন্য আমিরুল হাজ্জ নিযুক্ত করেন। সেই সময় আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) কাফিরদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের আয়াত পাঠ করেন।
আরো পড়ুন :
- প্রতিদিনের ইসলামিক গল্প – অকালের ফল
- হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) ও মলকুল মউত
- উত্তম চরিত্র নিয়ে ইসলামিক উক্তি এবং হাদিস
- প্রতিদিনের ইসলামিক গল্প – নেকড়ে বাঘের সাক্ষ্য
হযরত মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি আবু বাকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে মসজিদে নববিতে ইমামতির দায়িত্ব দেন। ৮ জুন ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে হযরত মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ইন্তেকালের পর উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এবং তার বন্ধুরা আবু বাকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর নাম মুসলিম সমাজের প্রধান হিসেবে প্রস্তাব করেন। তিনি কোনো নতুন নীতি বা ধারণা প্রবর্তন করেননি। বরং হযরত মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাহাবাদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে সক্ষম হন।
তার সরল অথচ দৃঢ় চরিত্রের কারণে তাকে হযরত মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রতিরূপ বলা হতো। নবীন মুসলিম সমাজের সবচেয়ে কঠিন ও বিপজ্জনক সময়ে তিনি নেতৃত্ব দেন এবং মৃত্যুর সময় এমন শক্তিশালী অবস্থায় রেখে যান যা উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর জন্য নেতৃত্ব সহজ করে।
হযরত মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আদেশ অনুযায়ী, তিনি আরবের সংকটময় পরিস্থিতি সত্ত্বেও যুবক উসামার অধীনে জর্ডানের পূর্বাঞ্চলে একটি অভিযান পাঠান। বিভিন্ন গোত্র মদিনার রাজনৈতিক প্রভাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে তিনি কঠোর পদক্ষেপ নেন। তবে যুদ্ধে বিজয়ের পর পরাজিতদের সঙ্গে সদয় আচরণ করতেন।
আরো পড়ুন : হযরত আবু বকর রাঃ এর জীবনী রচনা পর্ব -০১
তার শাসনামলে আরব ভূমিতে অভ্যন্তরীণ শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি খালিদ বিন ওয়ালিদ ও অন্যান্য সেনাপতিকে পারস্য ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে পাঠান।
তার স্বল্পকালীন শাসনকালেই আরব বাহিনীর প্রথম বড় বিজয় অর্জিত হয়। ১৩ আগস্ট ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন। হযরত মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পাশে তাকে দাফন করা হয়।
তার শাসনকাল মূলত যুদ্ধের মধ্যেই অতিবাহিত হয়। তবে তার সরল জীবনযাপন এবং বিনয়ের কারণে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন। তার চরিত্র ও নেতৃত্ব মুসলিম সমাজে স্থিতিশীলতা এবং ঐক্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
হযরত আবু বকর রাঃ এর মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে (১৩ হিজরি) হযরত আবু বকর (রাঃ) ইন্তেকাল করেন। তাঁকে নবী করিম (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পাশে দাফন করা হয়। তাঁর স্বল্পকালীন খিলাফত মূলত যুদ্ধ ও ইসলামের ভিত মজবুত করতেই অতিবাহিত হয়।